জাকাত : অনুকম্পা নয় দায়িত্ব
জাকাত : অনুকম্পা নয় দায়িত্ব
ইসলামি শরিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো জাকাত। সহায়-সম্বলহীন মানবতার অর্থনৈতি নিরাপত্তার গ্যারান্টি হলো জাকাত। আল কুরআনের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপর নামাজের মতো জাকাতের বিধানও চালু ছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাকাতের বিধান চালু করে আর্তমানবতার প্রতি চরম অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন।
জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ : জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে বিশিষ্ট অভিধানবেত্তা ইবন মানযূর ‘লিসানুল আরাব’ গ্রন্থে বলেন, জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ও প্রশংসা করা। মু‘জামুল ওয়াসিত নামক অভিধান প্রণেতা বলেন- জাকাত অর্থ প্রবৃদ্ধি, ক্রমবৃদ্ধি, পবিত্রতা, সংশোধন ও কোনো জিনিসকে পরিষ্কার করা। জাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং জাকাত দানকারীর আত্মা ও মনও পবিত্র হয়। জাকাত মালকে বৃদ্ধি করে। এ বৃদ্ধি বাহ্যিক দৃষ্টিতেও হতে পারে, আবার অর্থগত ও তাৎপর্যগত দিক থেকেও হতে পারে। কাজেই পবিত্র করা ও বৃদ্ধি করা এই দুই অর্থেই জাকাতকে জাকাত বলা হয়।
জাকাতের পারিভাষিক সংজ্ঞা : শরিয়তের পরিভাষায় জাকাত বলা হয়- শরিয়তের নির্দেশ ও নির্ধারণ অনুযায়ী নিজের মালের একাংশের স্বত্বাধিকার কোনো অভাবি গরিবের প্রতি অর্পণ করা এবং এর লাভালাভ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা। আল ইমাম নাবাবি (র:) বলেন- ধন ও মাল থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ বের করাকে জাকাত বলে। আল কুরআন ও হাদিসে জাকাত শব্দটি সাদাকাহ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আল্লাহ সুরাতুত তাওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ করুন। এর মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন’।
জাকাতের নিসাব ও খাতগুলো : কারো কাছে ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা উভয় বস্তুর যেকোনো একটির অর্থের সমপরিমাণ সম্পদ কারো কাছে থাকে তবে তাকে বছরান্তে ২.৫ শতাংশ হারে এবং বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলের ‘উশর তথা এক দশমাংশ ও সেচে উৎপাদিত ফসলের অর্ধ ‘উশর তথা ২০ ভাগের এক ভাগ জাকাত আল কুরআনে বর্ণিত খাতগুলোতে প্রদান করতে হবে। আল কুরআনে বর্ণিত খাতগুলো হলো- ১. ফকির (যার কিছুই নেই) ২. মিসকিন (যার কিছু আছে, তবে নিসাব পরিমাণ নয়) ৩. জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী ৪. (অমুসলিমদের) মন জয় করার জন্য ৫. দাসমুক্তির জন্য ৬. আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে ৭. ঋণমুক্তির জন্য ও ৮. মুসাফির (যিনি ভ্রমণকালে অনটনে পতিত হয়েছেন)।
জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে জাকাতের স্থান তৃতীয়। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী সা: বলেন- ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাসূল। নামাজ কায়েম করা, জাকাত দেয়া, হজ করা এবং রমজান মাসের রোজা রাখা’। (সাহিহুল বুখারি, হাদিস নম্বর ৮)। জাকাত ফরজ এটি বিশ্বাস করাও ফরজ এবং আমল করাও ফরজ। বিশ্বাস না করলে কাফির বলে পরিগণিত হবে এবং আমল না করলে অর্থাৎ জাকাত আদায় না করলে কবিরা গুনাহ হবে। নবী সা:-এর ইন্তিকালের পর একটি গোষ্ঠী জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানালে খলিফা হজরত আবু বকর (রা:) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন বলে ঘোষণা করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব কত বেশি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনে ৩০ বার জাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ২৭ বার নামাজের পরপরই উল্লেখ করেছেন। যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরাতুন নূরের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং রাসূল সা:-এর আনুগত্য করো। সম্ভবত তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’। অনুরূপভাবে আল্লাহ সুরাতুল হজের ৪১ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘আমি যদি তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতা প্রদান করি তবে তারা নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দান করবে’।
জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়ায় এটি আদায়ে যেমন অশেষ সওয়াবের কথা ঘোষিত হয়েছে, তেমনি আদায় না করলে ভয়াবহ পরিণতির কথাও বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরাতুল বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য গচ্ছিত করে রাখে, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের পীড়াদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’। এ ব্যাপারে নবী সা:-এর হাদিসেও কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন- ‘আল্লাহ যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন ওই ধনসম্পদ তার জন্য একটি টাক মাথাওয়ালা বিষধর সাপে রূপান্তরিত হবে, যার (চোখ দুটোর ওপর) দু’টি কালো বিন্দু থাকবে এবং ওই সাপ তার গলদেশে পেঁচানো হবে। অতঃপর সাপটি ওই ব্যক্তির উভয় চোয়াল কামড়ে ধরে বলবে- আমিই তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ভাণ্ডার।
জাকাত গরিবের হক, অনুকম্পা নয়: ইসলামি দর্শন অনুযায়ী পৃথিবীর সমুদয় সম্পত্তির মালিক আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সুনির্দিষ্ট পন্থায় ভোগাধিকার প্রদান করেছেন। সমুদয় সম্পত্তিতে সব মানুষের অধিকার রয়েছে। আল্লাহ কাউকে কর্মক্ষম করেছেন এবং কাউকে কর্মে অক্ষম করেছেন। যারা কর্মক্ষম তাদের সম্পত্তিতে কর্মে অক্ষমদের অধিকার রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরাতুয জারিয়াত এর ১৯ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’।
জাকাত সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে : জাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কেউ অর্থের পাহাড় গড়ে তুলবে আর কেউ তীব্র ক্ষুধার জঠর-জ্বালা নিবারণের জন্য একমুঠো খাবার পাবে না এটি ইসলামে স্বীকৃত নয়। এ ধরনের বৈষম্য বিরাজমান থাকলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বহাল থাকতে পারে না।
নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা চালু থাকায় বর্তমান পৃথিবীতে ধনী-গরিবের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। বর্তমান যুগকে উন্নয়নের যুগ বলা হলেও এটি প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন নয়, বরং এটি উন্নয়নের টিউমার। টিউমার যত বড় হবে জীবনের জন্য তা তত বেশি ক্ষতিকর। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে ৯৯ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। মাত্র ৬২টি পরিবারের হাতে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। অপরপক্ষে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। ফলে সমাজ থেকে আজ শান্তি নামক সুখ পাখিটা চিরবিদায় গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর বৈষম্য পর্বতসম বললে বাংলাদেশের বৈষম্য পাহাড়সম বলতে হয়। ২০১৬ সালের এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছেÑ বাংলাদেশের মানুষের মোট আয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় মাত্র দশ শতাংশ ধনীর পকেটে। আর জীবনমানের নিচের দিকে থাকা চল্লিশ শতাংশ গরিবের পকেটে যায় মাত্র ১৩ শতাংশ আয়। (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার এর ‘রাজনীতি, সুশাসন এবং মধ্যম আয়ের আকাক্সক্ষা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন, প্রথম আলো, ৯ জুন, ২০১৬)। ২ এপ্রিল ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) এক অধিবেশনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী বলেছেন- নিরাপত্তা ও সামাজিক শান্তির ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বড় হুমকি হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও আয় ব্যবধান। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২ এপ্রিল, ২০১৭)। বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদ ৮ ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ‘অক্সফোর্ড কমিটি ফর ফেমিন রিলিফ’ (অক্সফাম) এর প্রতিবেদনে বলা হয়- বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আট ধনকুবেরের হাতে দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে। (দৈনিক যুগান্তর, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ খ্রি: দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ খ্রি:)। এভাবে যাতে গুটিকয়েক মানুষের হাতে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ কুক্ষিগত না হয় সে জন্যই ইসলামে জাকাত প্রথার প্রবর্তন। আল্লাহ তায়ালা সুরাতুল হাশরের ৭ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘যাতে তোমাদের ধনীদের মধ্যে সম্পদ কুক্ষিগত না হয়’।
জাকাত কর্ম সংস্থান তৈরি করত দারিদ্র্যবিমোচন করে : জাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্যবিমোচন। এমন প্রক্রিয়ায় জাকাত দেয়া সমীচীন নয় যাতে গরিব গরিবই থেকে যায় এবং প্রতি বছর সে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। একজন জাকাতদাতা কোনো গরিব ব্যক্তিকে ১০ কেজি চাল বা একটি শাড়ি বা কিছু টাকা বা এই জাতীয় কিছু দিলো, সে কয়েকদিনে টাকা বা চাল শেষ করে দিলো, কাপড়টি সে পরিধান করে পুরনো করে দিলো। ফলে সে গরিবই থেকে গেল। জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান করা উচিত যাতে সে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার পরিচালনা করতে পারে।
দরিদ্রকে কি পরিমাণ জাকাত দিতে হবে এ সম্পর্কে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ‘উমার (রা:) বলেন- ‘যখন তোমরা দিবে তখন ধনী বানিয়ে দাও’। (মুহাম্মাদ লোকমান হাকিম, দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতের ভূমিকা, পৃ. ১৩৮)।
জাকাত আদায় করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র জাকাত আদায় করে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সমাজউন্নয়ে ব্যয় করবে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশে সরকারি আইন বা নির্দেশে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায় হয়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইরান, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, জর্দান, বাহরাইন, লেবানন, সুদান, কুয়েত ও ইয়েমেন। বাংলাদেশেও এ উদ্দেশ্যে জাকাত বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৪-১৬৫)। কিন্তু এ বোর্ড মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষ এ বোর্ডে জাকাত জমা দেয় না। ফলে আমাদের দেশে মসজিদভিত্তিক বা এলাকাভিত্তিক (যেমনÑইউনিয়নভিত্তিক বা উপজেলাভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক) আলিম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে জাকাত বোর্ড গঠন করে পরিকল্পিত উপায়ে জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে বা মানবসম্পদ উন্ননে ভূমিকা রাখা যেতে পারে। বোর্ডের আওতাধীন এলাকার জাকাতের হকদার ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করা যেতে পারে। যেমন- নিঃস্ব যুবককে একটি ভ্যান ক্রয় করে দেয়া যায়, দুস্থ মহিলা হলে তাকে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে দেয়া যায়, বয়স্ক হলে তার জন্য একটি দোকানের ব্যবস্থা করা যায় ইত্যাদি। কেউ কর্মে অক্ষম হলে তার জন্য একটি অটোরিকশা বরাদ্দ দিয়ে ভাড়ায় খাটানো যায়।
লেখক : অধ্যক্ষ
No comments